বীরভূমের লাল মাটির মধ্যে ঝকঝকে সাদা মাটির ঢেউ। বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে চোখ ধাঁধানো সাদা মাটির পাহাড়। কোথাও ল্যাটেরাইট মাটির ভিতরে স্তরে স্তরে জমা হয়ে আছে সেই সাদা মাটি। অবাক লাগছে তো? এদের বয়স জিওলজিক্যাল পরিসংখ্যানে কয়েক লক্ষেরও বেশি। রাজমহল পাহাড় যখন তৈরি হয়েছিল স্বয়ং হিমালয় পর্বতও তখন টেথিস সাগরের তলায় জন্মায়নি। মনে করা হয় কয়েক হাজার বছর আগে এই রাজমহল পাহাড় থেকেই প্রাকৃতিক ভাবে বা কোনো ভূ-বিপর্যয়ে এই সাদা মাটি এসে জমা হয়েছিল বীরভূমে। পরে তা চলে গেছে মাটির নিচে। তারপর একদিন হঠাৎ হয়তো এই লাল মাটির দেশের আদিবাসী সাঁওতাল খুঁজে পেয়েছেন অদ্ভুত এই সাদা মাটির খনি।
১৯৫৫ সালে তৈরি হয়েছিল গ্রাইন্ডিং ইউনিট প্যাটেলনগর মিনারেলস প্রাইভেট লিমিটেড। এটি ভারতের প্রাচীনতম খড়িমাটি মাইনিং এবং প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলির মধ্যে একটি। বীরভূমের মহম্মদবাজারের খড়িয়া গ্রামের খাদানগুলি সেই সংস্থারই অংশ। খড়িয়া গ্রাম এবং সারা মহম্মদবাজার, দুবরাজপুর এলাকায় মোট পাঁচ-সাতটি খাদানের সবগুলিই তৈরি হয়েছে পঞ্চাশ থেকে ষাটের দশকের মধ্যে। এইসব খাদানে মাটির তলা থেকে খড়িমাটি বা চায়না ক্লে তোলা হয়। প্রক্রিয়াকরণের শেষে ছড়িয়ে যায় ভারত, বাংলাদেশ সহ অন্যান্য জায়গাতেও। রাবার শিল্প, ওষুধ তৈরি, রং তৈরির কাজে এই খড়িমাটি ব্যবহার হয়। খাদানের শ্রমিকদের অধিকাংশই তফসিলি জাতি ও অন্যান্য উপজাতি সম্প্রদায়ের। বেশি কাজ করেন আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা আদিবাসী মহিলারা। এইসব কর্মচারীরা সকলেই দিনমজুরের মত খাটেন। তাঁদের নিজস্ব কোনো শ্রমিক ইউনিয়ন নেই। এঁরা কেউই প্রভিডেন্ট ফান্ড এবং গ্র্যাচুইটির মতো সুরক্ষা বা সুবিধা পান না।
জিওলজিক্যাল আবিষ্কার এবং ব্যাখ্যার বহু আগে থেকেই স্থানীয় আদিবাসীরা এই খড়িমাটির ব্যবহার জানতেন। মাটি তুলে, তাকে জলে ভিজিয়ে রেখে, তাতে রং গুলে বা সাদা মাটিকেই তাঁরা ব্যবহার করতেন বাড়ি রাঙাবার কাজে। আলপনা দেওয়ার কাজে। পট আঁকার কাজে। এখনও বীরভূমের আদিবাসী গ্রামগুলিতে ঢুকলে শহুরে মানুষ অবাক হবেন। প্রতিটি বাড়ির দেওয়াল হাতে আঁকা কারুকার্যে ভরা। পাহাড়ের মানুষেরা যেভাবে বাড়িকে রঙিন ফুল দিয়ে সাজান। সমতলের আদিবাসীদের বাড়ি মাটি দিয়ে, রং দিয়ে সেজে থাকে। আজও স্থানীয় আদিবাসীরা খাদান থেকে বস্তা ভরে মাটি সংগ্রহ করে নিয়ে যান নিজেদের কাজে। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ার আদিবাসী গ্রামগুলিতে গেলেই তাই বোঝা যায়, কীভাবে প্রকৃতির শত রুক্ষতার মধ্যেও মাটির কাছাকাছি মানুষেরাই লাবণ্য ফুটিয়ে তুলতে পারেন অনায়াসে।
Discussion about this post