৭৯ বছর বয়স হলো তার, কদিন আগেই। চোখ খানিক ঝাপসা হয়েছে, আলুলায়িত ধূসর চুল ছুঁয়েছে কাঁধ। কিন্ত কন্ঠস্বর আর লেখনীর তীব্রতা রয়ে গিয়েছে আগের মতোই। সেরার শিরোপা তার পায়ে লুটিয়ে পড়েছে বহুবার, এমনকি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও। তবু তিনি মৌলিক, মেইনস্ট্রিম বিরোধী, ইমেজ ধরে রাখার চেয়ে ধিক্কার জানানোয় বেশি সাবলীল। তিনি মার্কিন লোকগীতির জীবিত কিংবদন্তী – বব ডিলান। তার নতুন অ্যালবাম রিলিজ করছে আগামী শুক্রবার, নাম – ‘Rough and Rowdy Ways’। বছর আটেক পর নতুন মৌলিক নিজস্ব গান নিয়ে, এমনি সিঙ্গেলসও নয়, সরাসরি সংকলন নিয়েই হাজির হচ্ছেন তিনি। বিখ্যাত মার্কিন রক জার্নাল লিখছে – ‘সুতীব্র ও সময় সচেতন ডিলান’!
এখানে প্রশ্ন ওঠে, সময় বলতে আদতে কী? কোন সময়? সময় এই পরিস্থিতির, সময় এই টালমাটালের। যখন ডিলানের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে জর্জরিত করোনা মহামারীর লাগামছাড়া সংক্রমণে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের যৌবন নেমে এসেছে রাস্তায়, তারা পথে নেমেছে জ্বলন্ত ক্ষোভ বুকে নিয়ে। কারণ রাষ্ট্রব্যাপী, এমনকি বিশ্বব্যাপী জনগণ স্মার্টফোনের নীল পর্দায় দেখেছে ভয়াবহ পুলিশি অত্যাচারে জর্জ ফ্লয়েডের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু। আমেরিকা সঙ্কল্প নিয়েছে এই রাষ্ট্রব্যবস্থা তারা আর মেনে নেবেনা। কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর পাশবিক অত্যাচার ও বর্ণবিদ্বেষের যে ধারা ঐতিহাসিকভাবে অব্যাহত রয়েছে তা ভেঙে দুমড়ে গুঁড়িয়ে দিতে চায় এই উদ্ধত যৌবন। তাই মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করেই যেন মার্কিন মুলুকে রাস্তায় নেমে রাষ্ট্র নির্মাণের কাজ চলছে। মৃত্যুর ভয়াবহ শেষ দংশনকে সামনে থেকে দেখেই ‘survival mechanism’-এ পাল্টা জবাব দিতে বেরিয়ে এসেছে আমেরিকার যুবশক্তি। এই পরিস্থিতিতে ডিলানের আবির্ভাব ও সঙ্গে নতুন অ্যালবাম আশার আলো দেখাচ্ছে আমেরিকা ও বিশ্বকে, যারা রাস্তায় নেমে চিৎকৃত স্বরে ছুঁড়ে দিচ্ছেন “I can’t breathe.” হয়তো তাদের জন্য এক ঝলক অক্সিজেন নিয়ে ছুটে আসছে এই অ্যালবাম। সমাজ চেতনার ধারক, বাহক ও প্রতিপালকের ভূমিকা পালনের শিল্প বেরিয়ে পড়ছে রাজপথে।
এপ্রিলের এক ভোর রাতে ডিলান মার্কিন গণচেতনাকে তাক করে ছুঁড়ে মারেন একটি সতেরো মিনিট দীর্ঘ একক গান – ‘Murder Most Foul’. গানের বিষয়বস্তু প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির হত্যা। হ্যাঁ, তিনি জানতেন যেখানে খোঁচা লাগার লেগে যাবে. ধারালো ও তীক্ষ্ণ শিল্পের ধর্মই যে আসলে এরকম। গানের মাঝেই জুড়ে দিলেন পংক্তি, Freedom, oh freedom Freedom above me I hate to tell you, mister, but only dead men are free” গত সপ্তাহে ডিলান দিয়েছেন একটি পাবলিক ইন্টারভিউ দীর্ঘ চার বছরের মৌনতা ভঙ্গ করে। তীব্র ভাষায় সেই টেলিফোন সংলাপে বুঝিয়ে দিয়েছেন নিজের মানসিক অবস্থা। জর্জ ফ্লয়েড হত্যা নিয়ে তিনি আহত ও রক্তাক্ত তা তাঁর বক্তব্যে স্পষ্ট, বলেছেন – “এই হত্যা পাশবিক, কুৎসিত ও কল্পনাতীত। এই ঘটনা আমায় চূড়ান্তভাবে অসুস্থতাবোধ দিয়ে যাচ্ছে। আশা করবো সুবিচার হবে, জর্জের পরিবার এবং আমরা সমগ্র রাষ্ট্রবাসী সুবিচারের প্রত্যাশা রাখছি। তবে সভ্যসমাজে এই ঘটনার বারংবার পুনরাবৃত্তি বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
এরপর কথায় কথায় চলে এসেছেন নিজের পরবর্তী সঙ্গীত সংকলন প্রসঙ্গে। সে বিষয়ে তাঁর উক্তি – “এই পরিস্থিতিতে গান লেখা যায় না, এই গানগুলো নিজেরাই নিজেদের লিখে ফেলেছে।” ‘Rough and Rowdy Ways’ অ্যালবামে মোট দশটি গান রয়েছে। এই গানগুলি চিরাচরিত ডিলানধর্মী ভাবেই একে অন্যের চেয়ে আলোকবর্ষ দূরত্বে পৃথক, আবার কখনো যেন একসূত্রেই বাঁধা। কোনও ট্র্যাক তীব্র ব্লুজধর্মী মূর্চ্ছনায় আছন্ন করছে তো কোথাও এক ট্র্যাক গল্প বলছে ধ্বংসাত্বক রোম্যান্টিসিজমের। সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন ‘অ্যাপোক্যালিপ্টিক’ সূচনাকে সাক্ষী রেখেই করেছেন এই কাজটি। শেষের সে দিন আসার আগেই শুক্রবার অর্থাৎ ১৯ জুন ডিলানের চোখ দিয়ে এই ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’কে প্রত্যক্ষ করতে প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমী মহল।
Discussion about this post