ফুটবলপ্রেমী ভারতবাসীর কাছে আজও আক্ষেপের জায়গা ভারতীয় দলের ১৯৫০-এর বিশ্বকাপ ফুটবল না খেলতে পারা। বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ভারত শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পেয়েছে একাধিকবার। কিন্তু ফুটবলে? সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্বকাপ ফুটবলে ভারতের খেলতে না যাওয়ার কারণ নিয়ে রয়েছে নানা রকমের মতবিরোধ। কেউ বলেন ভারতের ফুটবলারদের বুট কেনার ক্ষমতা না থাকা এর মূল কারণ। আবার কেউ বলেন ভারতীয় ফুটবলারদের বুট পড়ে খেলার অভ্যাস না থাকাই বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আবার কারোর মত, যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার অভাব বা দীর্ঘ সমুদ্র যাত্রার ভয় কিংবা বিশ্বকাপে খারাপ ফলের আশঙ্কাই এর কারণ। কিন্তু শুনলে অবাক হবেন কারণ আসল সত্যিটা একেবারেই আলাদা। এর নেপথ্যে রয়েছে একেবারেই অন্য ঘটনা। চলুন আজ সেই দিকটাই উন্মোচনের চেষ্টা করা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন সবে শেষ হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই বিশ্বকাপের জন্য উঠে পড়ে লাগে ফিফা। কিন্তু ইউরােপের যা অবস্থা, তাতে ইউরােপের কোনো দেশই নিজের দেশে বিশ্বকাপ আয়োজন করাতে তেমন আগ্রহী ছিল না। এই অবস্থায় ব্রাজিল তাদের দেশে বিশ্বকাপ করার জন্য আবেদন জানায়। সেই আবেদন আনন্দের সাথে গ্রহণ করে ফিফা। ১৯৫০ সালের মে মাসে জুরিখে ফিফা দফতর থেকে বিশ্বকাপের গ্রুপ বিন্যাস জানিয়ে ভারতের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অনুরোধ করে ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের কাছে চিঠি পাঠানো হয়। এই খবরে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু। এশিয়া মহাদেশ থেকে বিশ্বকাপ খেলার জন্য একমাত্র নির্বাচিত দেশ হিসেবে ভারতের ডাক পড়ে বিশ্বকাপে। এছাড়াও সেই বিশ্বকাপে ছিল ৭টি ইউরোপিয়ান এবং ৬ টি লাতিন আমেরিকান দেশ। সেখানে তৃতীয় গ্রুপে সুইডেন, ইটালি এবং প্যারাগুয়ের সাথে ভারতের খেলা নির্ধারিত হয়। ভারতবর্ষের খেলার তারিখ নির্বাচিত হয় ২৫শে জুন।
সেই সময়ের ভারতীয় ফুটবল দলের তাবড় তাবড় খেলোয়াড়দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শৈলেন মান্না, আমেদ খান, মেওয়ালালের মত ব্যক্তিত্বরা। কিন্তু এর পরবর্তীতে ঘটে বিপত্তি। ২৩ মে ভারতীয় দলের নাম প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। যার অজুহাত হিসেবে ব্রাজিলে আসা-যাওয়ার খরচ, প্র্যাকটিস করার সময়ের অভাব, দল নির্বাচন নিয়ে সমস্যা ইত্যাদিকে খাড়া করা হয়। যদিও শোনা যায়, খেলার প্রস্তুতির জন্য নাকি ভারতীয় দল যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। বিশ্বকাপের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল মনুমেন্টের সামনে সিটি মাঠে প্রখ্যাত কোচ হ্যারি রাইটের তত্ত্বাবধানে। এমনকি সেখানে কলকাতার বাইরের প্লেয়ারদেরদেরও ডেকে নেওয়া হয়। সেই সময় ভারতে অলিম্পিককে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলা হতো। বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে যদি ১৯৫২-র অলিম্পিক হাতছাড়া হয়ে যায়, এই ভয় নাকি চেপে ধরে খেলোয়াড়দের। যার বশবর্তী হয়ে ১৯৫১ ভারতে এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় এবং বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রতি খেলোয়াড়রা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। পরবর্তীকালে, ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “আমাদের বিশ্বকাপ নিয়ে কোনও ধারণা ছিল না। যদি থাকতাে তাহলে আমরা নিজেরাই উদ্যোগ নিতাম যাওয়ার জন্য। সেসময় আমাদের জন্য অলিম্পিকই ছিল সবকিছু। কোনাে কিছুই অলিম্পিক থেকে বড় ছিল না।”
এ প্রসঙ্গে সঠিক তথ্য উন্মোচনের জন্য ডেইলি নিউজ রিল পৌঁছে গিয়েছিল ক্রীড়া ঐতিহাসিক ড.কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। এ প্রসঙ্গে কৌশিকবাবু জানান, “১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল খেলতে না পারার পেছনে মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায় ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের উদ্যোগের অভাব ও অব্যবস্থা। সেসময় ব্রাজিলের বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটি ভারতীয় দলের খরচের সিংহভাগই বহন করতে রাজি হয়। ভারতের কয়েকটি প্রাদেশিক ফুটবল সংস্থাও অর্থ সাহায্য করতে এগিয়েও আসে। কিন্তু তা সত্বেও নির্দিষ্ট পরিকল্পনা আর ভারত সরকারের সাথে সমন্বয়ের অভাবই ভারতকে বিশ্বকাপ ফুটবলের আসর থেকে সরিয়ে নেয়। তা সত্ত্বেও হঠাৎ করে এআইএফএফ’র এই সিদ্ধান্ত ফুটবলপ্রেমী দেশবাসী ও খেলোয়াড়দের বড় অংশকে স্তম্ভিত করেছিল।” তিনি আরও বলেন, “সে সময়কার ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স যথেষ্ট ভাল ছিল, ফলতঃ ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল ভারতের ফুটবলের ইতিহাসে নতুন মোড় নিতে পারত। যা এই ২০২০ সালে দাঁড়িয়েও আজও সম্ভবপর হয়ে ওঠে নি।”
একটা কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে ভারতবর্ষ যদি সত্যিই খেলত তাহলে তা হত ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ঘটনা। যা হয়তো পাল্টেই দিত ভারতীয় ফুটবলের গতিপ্রকৃতি। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, সে সময় ভারতীয় দলের অন্যতম খেলোয়াড় হায়দ্রাবাদ পুলিশের এস কে আজিজুদ্দিন, নুর মহম্মদ প্রমুখরা বুট পরেই খেলতন। তাই বলাই যায়, শুধু বুট পড়ে না খেলতে পারার জন্য বিশ্বকাপে অংশ না নেওয়ার যে ভ্রান্ত ধারণা ভারতবাসীর মনে গেঁথে ছিল তা অনেকাংশেই ভিত্তিহীন।
Discussion about this post