বাঙালি যেচে বাঁশ খেতে না চাইলেও বাঁশের তৈরি জিনিসে ওজর-আপত্তি করে না। বাংলার লোকশিল্পের অন্যতম উপাদান বাঁশ। এই বাঁশ থেকে ‘কাবারি’ বানিয়ে যে শুধু ঝুড়ি, ঝাঁজুরি, ছানি কাটার বাজরা তৈরি হয় তাই নয়, মাছ ধরার নসি, বিত্তি, পলুই, আড়া ঝোপড়াও বুনে থাকেন লোকশিল্পীরা। গ্রামবাংলার মাটির চালাঘরগুলি দাঁড়িয়ে থাকে কাঠ বা বাঁশের খুঁটির জোরে। ঘরামিরা ধাপে ধাপে কাদা দিয়ে দেওয়াল তােলে। সূত্রধররা কাঠ দিয়ে নানা ভঙ্গিতে তৈরি করে দেন চালাঘরের চাল ধরে রাখার কাঠামাে। বারুইরা খড় ও বাঁশ-বেত দিয়ে ঘরের চাল ছেয়ে দেন।
বাঁশ শিল্প মোটামুটি বাঁকুড়া জেলার সব অঞ্চলেই বিখ্যাত। বাঁকুড়ার সোনামুখী এবং কেঞ্জাকুরাতেও বাঁশ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র, শৌখীন জিনিস তৈরি করা হয়। তবে ইন্দাসের শ্বাসপুর এবং গঙ্গাজলঘাটির রাজামেলা গ্রামের অধিকাংশ পরিবার এই শিল্পের সঙ্গে বিশেষভাবে যুক্ত। সকাল হলেই শুরু হয় বাঁশ, বেত দিয়ে গৃহস্থালির নানান জিনিস তৈরির কাজ। পরিবারের সকলে মিলে এই কাজ করে এবং তা বাজারে বিক্রি করে। এখানকার স্থানীয় মানুষেরা বাঁশ দিয়ে ডালি, কুলো, চাটাই, চালন, খাঁচা সহ নানা ধরনের জিনিস তৈরি করে থাকেন।
বাঁশ-বেতের কাজে মূল সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে থাকে শিল্পীর ভাবনায়। আর তার প্রকাশ ঘটে বুনন ও মেলাইয়ের দক্ষতায়। মাঝে মাঝে জলের ছিটে মেরে মেরে বাঁশ ও বেতকে নরম করে নেওয়া। চতুর্থ আঙ্গুলের সাহায্যে এক-দুই-তিন করে গেঁথে ফেলা। বুদ্ধিদীপ্ত কৌশলে একটা নির্দিষ্ট রূপ দেওয়া। অর্থাৎ বংশ পরম্পরায় চর্চিত জ্ঞান নিয়ে সেজে ওঠে বাঁশ-বেত শিল্প। লক্ষীর হাঁড়ি থেকে ফুলের সাজি, পালকির আকারে বিয়ের শৌখীন ডালা এমনকি বরণডালা। এইসব কিছুতেই বাঁশের জুড়ি মেলা ভার। বাঁশ-বেত দিয়ে তৈরি মাছ, কচ্ছপ, ফুলদানি, টব রাখার উঁচু থাম, টেবিল ল্যাম্প, হ্যাজাক লাইট, বাল্বের ছাতা শেড, ঘড়ির-বেল্ট, মেয়েদের মাথার ক্লিপ, পাখির বাসার মতাে দোলনা। এই প্রতিটা জিনিসই খুবই আকর্ষণীয়। কৃষি কাজে বাঁশ-বেতকে অবজ্ঞা করার কোন প্রশ্নই নেই। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে বাঁশ-বেত শিল্পের চাহিদা সম্পূর্ণরূপে প্রয়ােজনকেন্দ্রিক। যদিও শহরে এই শিল্প খুব একটা খাতির পায় না।
প্লাস্টিকের সামগ্রীর বাড়বাড়ন্তের কারণে এই শিল্পের চাহিদা আগের মত নেই। নেই এই শিল্পের ওপর নির্ভর করে থাকা কারিগরদের ব্যস্ততা। তবুও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের কারিগররা তাদের পূর্বপুরুষের পেশা আঁকড়ে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। বর্তমানে বাঁশ ও বেত শিল্পের বিভিন্ন মনোমুগ্ধকর জিনিসকে হার মানাচ্ছে প্লাস্টিকের তৈরি জিনিস। যদিও রাজামেলা গ্রামের ৮০ টি পরিবার এই জীবিকার সঙ্গে যুক্ত। অনেকই আবার অভাবের তাড়নায় এই পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাচ্ছেন। সরকারের উদাসীনতার কারণেই ওই এলাকার বাঁশ শিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে বলেই জানান স্থানীয় শিল্পীরা। বাংলার ঐতিহ্য বাঁশ ও বেতের সামগ্রীকে টিকিয়ে রাখতে হলে এর পেছনের মানুষগুলোকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে হবে। বাঁশ ও বেত শিল্পকে বাঁচাতে সবার এগিয়ে আসা উচিত। এই শিল্প আমাদের আদিকালের ঐতিহ্য। এটিকে জীবন্ত রাখা আমাদের সবার উচিৎ।
Discussion about this post