আট থেকে আশি, তাস নিয়ে নির্ভেজাল আড্ডা দিতে কে না ভালোবাসে? তবে এ এক অন্যরকম তাসের গল্প। যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বাংলার ইতিহাস, বাংলার অতীত। বিষ্ণুপুর, বাংলার এক অতুলনীয় স্থান। শিল্পকলা, গান, পোড়ামাটির মন্দির, বালুচরী শাড়ি, শঙ্খ শিল্প, শাস্ত্রীয় সংগীত সমস্ত কিছুর ইতিহাস বয়ে নিয়ে চলেছে এই মল্লরাজ ভূমি। এই সবের মধ্যে বিষ্ণুপুরের ‘দশাবতার তাস’ একটু বিশেষভাবে টানে আমাদের। এই তাসের ভাবনাও অনেক পুরনো। বিভিন্ন রঙের ব্যবহার করে খেলার তাস করে তোলার পরিকল্পনা যে কত পুরোনো সেটা কোনো ঐতিহাসিকও বলতে পারেননা। তবে ইতিহাসবিদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ১৮৯৫ সালের এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের এক ছোট্ট নোটে বলেছেন- “I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred years before the present date.”
প্রায় হাজার বছরেরও বেশি আগে, মল্লরাজ জগৎ মল্লের ইচ্ছায় বর্তমান কোতুলপুর থানার লাউগ্রামের বাসিন্দা কার্তিক সুত্রধর বিষ্ণুপুরে এসে দশাবতার তাস তৈরী শুরু করেন। পরে সূত্রধর পরিবারের কোনো এক কৃতী সন্তান মল্লরাজের সেনাপতি পদ লাভ করলে এই পরিবার ফৌজদার উপাধী লাভ করে। বর্তমানে এই একটিই পরিবারের সদস্যরা বংশানুক্রমিক ধারায় দশাবতার তাস তৈরীর ঐতিহ্য কোনোক্রমে টিকিয়ে রেখেছেন, কোনো সরকারী বা বেসরকারী সহায়তা ছাড়াই। মল্লরাজ পরিবারে এই খেলা শুরু হয়। তবে বিষ্ণুপুরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ খেলা জনপ্রিয় ছিল। মোগল দরবারেও এই খেলা পৌঁছেছিল। মোট একশ কুড়িটি তাস লাগে এই খেলায়। দশবতার তাসে বিষ্ণুর দশ অবতারের ছবি আছে তাই এইরকম নাম। তাস খেলার নাম হল ওরক খেলা। ওরক শব্দের অর্থ পাতা বা পত্র।
এই তাস তৈরী হয় তেঁতুল বীজের আঠায় সাদা সুতি কাপড়ের তিন পরত দিয়ে। তার পর আবার আঠা ও খড়ি মাটি দেওয়া হয়। খড়ি মাটির প্রলেপ দেওয়া কাপড়টি শুকিয়ে এলে নোড়া দিয়ে ঘষে মসৃণ করে গোল করে কেটে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় রং দেওয়ার পালা। সুক্ষ তুলির কাজ চলে। চূড়ান্ত ধৈর্য্য এবং পারদর্শিতায় তৈরী হয় এই তাস। এক প্রস্থ তাস তৈরিতে ১২০ টি তাস লাগে। এর মধ্যে ১০ টি তাসে বিষ্ণুর দশ অবতার – মৎস, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, জগ্ননাথ, বামন, পরশুরাম, রাম, বলরাম এবং কল্কি। প্রতি অবতারের অধীনে একজন রাজা ও একজন উজির থাকেন। এইভাবে প্রত্যেক অবতারের নিচে ১১টা তাস থাকে। প্রতিটি অবতারের আবার আলাদা আলাদা পয়েন্ট থাকে। এই পয়েন্টগুলি আবার সময় এবং আবহাওয়া অনুযায়ী বদলে যায়। যেমন সকাল বেলা সূর্য ওঠার পর ‘রাম’ অবতার তাসের পয়েন্ট সবচেয়ে বেশি কিন্তু সেই সময় বৃষ্টি হলে ‘কূর্ম’ অবতারের পয়েন্ট বেশী হবে।
মল্ল রাজাদের আমলে খেলার আগে স্নান করে শুদ্ধ কাপড়ে ৫ জন খেলোয়াড়কে আসতে হত। ৬ টি আসন পাতা হত। ৫ জন নিজ আসনে বসতেন, মাঝের আসন শ্রী বিষ্ণুর নামে রাখা হত। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফ্যাকাসে হয়ে আসছে দশাবতার তাসের মহিমা। হারিয়ে গিয়েছেন তাস-শিল্পীরা। টিমটিমে আলোটুকু জ্বালিয়ে রেখেছেন তাঁদেরই বংশধরেরা। বর্তমানে বিষ্ণুপুরের শিল্পী শীতল ফৌজদার এবং তাঁর পরিবারই একমাত্র এই তাসের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। দশাবতার তাস খেলায় না হলেও এখন ব্যবহৃত হয় সৌন্দার্যায়নে। বিষ্ণুপুরে শিল্পীদের নিজস্ব আস্তানা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গ সরকার পরিচালিত বিশ্ববাংলা আউটলেটগুলোয় এই তাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া, কয়েক বছর আগে কলকাতার কোনও এক পুজো প্যান্ডেলে থিম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল দশাবতার তাস। অতএব বলাই যায়, এই শিল্প নিয়ে সচেতনতা না বাড়ালে অচিরেই হারিয়ে যাবে বাংলার এই মূল্যবান ঐতিহ্য।
Discussion about this post