বাংলা সামাজিক নাটকের এক অন্য দিগন্তের নাম ডঃ অরুণ কুমার দে। বিখ্যাত নাট্যপালা ‘নটী-বিনোদিনী’ যিনি রচনা করেছিলেন, সেই লোকনাট্যকার ব্রজেন দে’র কথা আমাদের অনেকেরই জানা। তবে তাঁর পুত্রের সম্পর্কে হয়ত অনেক কিছুই অজানা রয়ে গেছে এই প্রজন্মের কাছে। নাট্যসম্রাট ব্রজেন দের সুযোগ্য পুত্রই ছিলেন বাংলার এক বিখ্যাত সামাজিক নাট্যকার ডঃ অরুণ কুমার দে। তবে নিজের পিতার পরিচয়ে নয়, বাঁচতে চেয়েছিলেন নিজের নামে, নিজস্ব পরিচয়ে। সত্তর ও আশির দশকে তাঁর রচিত নাটকের মাধ্যমে তিনি সৃষ্টি করেন আলোড়ন। যেগুলি সেইসময় তুমুল ভাবে অভিনীতও হতে থাকে অফিসপাড়ায় মঞ্চে।
অরুণ বাবুর জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুরের গয়ঘর গ্রামে। বাংলাদেশেরই মাদারীপুর, গোপাল গঞ্জ থেকে নিজের প্রাথমিক শিক্ষার জীবন শেষ করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে উচ্চ শিক্ষার উদ্দ্যেশ্যে কলকাতায় আসেন, ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। ঠিক সেই সময় থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি চলতে থাকে নাট্য-চর্চা। মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীনই তিনি লেখেন জীবনের প্রথম নাটক, ‘কার দোষ’। আশ্চর্যের বিষয় প্রথম লেখা হলেও সেই সময় তুমুল জনপ্রিয় হয় নাটকটি। ছাত্রাবস্থায় তিনি লেখেন আরও কয়েকটি নাটক। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ‘বাঘনখ’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘জোনাকি’ ও ‘বেকার’। তাঁর লেখা অধিকাংশ নাটকেরই বিষয় ছিল কুসংসস্কার ও সাম্প্রদায়িকতা। সেইসময় নকশালদের ওপরে পুলিশি অত্যাচার কিংবা টিবি, কুষ্ঠ রুগী এবং বারবণিতাদের অচ্ছুৎ করার বিপক্ষেও আওয়াজ তুলেছিলেন তিনি। সমাজের এইসব বস্তাপচা নিয়মের বিরুদ্ধে যাবতীয় ক্ষোভই তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর লেখা নাটকের মাধ্যমে। তাঁর লেখা শেষ নাটক ছিল ‘চালচিত্র’।
অরুণ বাবুর সমস্ত লেখার নেপথ্যে অনুপ্রেরণা ছিলেন তাঁর স্ত্রী রঞ্জিতা। সেইসময়ের কলেজস্ট্রিটের বিখ্যাত টাউন লাইব্রেরি, অক্ষয় লাইব্রেরি, ভৈরব পাবলিশার্স এবং নির্মল পুস্তকালয় ছাপতো তাঁর লেখা নাটক। তাঁর নাটকের মাধ্যমে গণতন্ত্র ও সাধারণ মানুষের জীবনের কথা বলে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন তিনি। নাটক লেখা ছাড়াও পেশায় তিনি ছিলেন চিকিৎসক। তাই তাঁর কর্মজীবনের বেশিরভাগ সময়ই কাটে ধুবুলিয়া টিবি হসপিটালে। এরপর তিনি পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত ‘ডিরেক্টর অফ হেলথ সার্ভিস’ পদে নিযুক্ত হন। প্লেগের সময় পরপর তিন রাত্রি থেকেছেন রাইটার্স বিল্ডিংয়ের স্বাস্থ্য দপ্তরেও। কোনও লবি বা রাজনীতির ছত্রছায়ায় নয়, একাই নিজের আদর্শে কাজ করে গেছিলেন আজীবন। কেউ কী করেন জিজ্ঞাসা করলে বলতেন, “হাসপাতালে কাজ করি!” তবে তাঁর কর্মজীবনের একটি ঘটনার উল্লেখ না করলেই নয়। একবার এক ডাক্তার রোগীদের প্রাপ্য খাবার চুরি করে আনতেন। ডঃ দে তা হাতেনাতে ধরে ফেলে শাস্তি দেন। এরপর সব ডাক্তাররা মিলে তাঁর মঞ্চস্থ নাটক বয়কট করে দর্শক শূন্য করার অপচেষ্টা করে। এমনকি এক রাতে বাড়িতে গুন্ডারও হামলা হয়। নির্ভয় অরুণ বাবু বুক চিতিয়ে দাঁড়ান তাঁদের সামনে। এমন হাড়হিম মুহূর্তে দু-চারজন গুন্ডা তাঁকে দেখে অবাক হয়ে হঠাৎই দুম করে প্রণাম করে বসে। হতচকিত ডাক্তারবাবুকে বলে, তাঁর লেখা নাটকে অভিনয় করেছে ওরা। এখন বেকারত্বের জ্বালায় কিছু টাকার লোভেই নাকি ডাক্তারবাবুকে মারতে এসেছিল। এরপর ডঃ দে তাদের নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় ব্রতী হন।
অবসরের পর ভারত সেবাশ্রমে দাতব্য চিকিৎসা করতেন তিনি। ভারত সেবাশ্রম (মুম্বাই) তাঁকে বিশেষ সম্মানও দেয়। এমনকি দিল্লির ‘বসুন্ধরা সাহিত্য পরিষদ’ তাঁকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট দিয়ে সম্মানিতও করেন। একদা যাঁর পরিচয় হতে পারতো ‘নটি বিনোদিনী’ সোনাই দীঘি খ্যাত লোকনাট্যগুরু ব্রজেন্দ্র কুমার দের পুত্র হিসেবে। কিন্তু চিরকালের প্রচার বিমুখ ডাঃ দে লেখা নিজস্ব বক্তব্যে অটুট থেকেই লেখা চালিয়ে গেছিলেন। তাঁর লেখার মাধ্যমেই সামাজিক নাটকের যুগান্তর ঘটিয়েছিলেন তিনি। সদা কর্মব্যস্ত ও কাজ পাগল এই মানুষটি ২০১৪ সালের ২৩ আগস্ট দিল্লিতে নিজের শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। শুধু রেখে গেলেন তাঁর লেখা নাটকগুলি এবং একমাত্র মেয়ে সঙ্ঘমিত্রা বনবিবি সেনকে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সামাজিক নাটকের এক অধ্যায় হয়তো সমাপ্ত হল। কিন্তু আজকের এই বাঙালি সমাজ কি এত সহজে ভুলে যাবে তাঁকে? নাকি তাঁর লেখাগুলিকে আঁকড়েই খুঁজবে সামাজিক নাট্যচিন্তার দলিল! এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে একমাত্র আগামীই!
তথ্য সূত্র – নাট্যকারের একমাত্র উত্তরাধিকারী এবং কন্যা সঙ্ঘমিত্রা বনবিবি সেন
Discussion about this post