রাউলাট আইনের প্রতিবাদে এবং সইফুদ্দিন কিচলু ও সত্যপালের মুক্তির দাবীতে শিখদের বৈশাখী উৎসবের দিন হাজার হাজার নিরস্ত্র মানুষ জড়ো হয় অমৃতসর শহরের জালিয়ানওয়ালাবাগ নামের একটি উদ্যানে। এই উদ্যানে যাওয়ার জন্য ছিলো একটি সংকীর্ণ গলিপথ এবং চারপাশে পাঁচিল, উদ্যানের ভিতরে ছিলো একটি কূপ। ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল-এর সেই ভয়াবহতার কথা ভাবলে ভারতবাসী আজও শিউরে ওঠে। জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে ঠিক ৫ টা বেজে ৩৭ মিনিটে জড়ো হওয়া জনতার ওপর এলোপাথারি গুলি চলে। দশ মিনিট গুলি চলায় মারা যায় প্রায় ১৫০০ মানুষ। সরকারি পরিসংখ্যান অবশ্য জানায় হতাহতের সংখ্যা ৩৭৯ জন। কেউ কেউ আতঙ্কে ঝাঁপ দেয় উদ্যানের কুয়োতে।
এই হত্যালীলার মধ্যেই মঞ্চের তলায় ঢুকে গিয়ে আত্মরক্ষা করেন ষষ্ঠীচরণ মুখার্জী। যিনি ছিলেন হুগলীর দশঘরার মানুষ। অল্প বয়সেই তিনি কংগ্রেসী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পেশায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ছিলেন ষষ্ঠীচরণ। স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করার জন্য পাড়ি দেন এলাহাবাদে। সেখানে বিভিন্ন কংগ্রেস নেতার সংস্পর্শে আসেন। ধীরে ধীরে মদনমোহন মালব্যের প্রিয় পাত্রও হয়ে ওঠেন। মালব্যের নির্দেশেই কংগ্রেস আন্দোলনের কাজে ১৯১০ সাল থেকে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগে বসবাস শুরু করেন। প্রত্যক্ষ করেন ডায়ারের নারকীয় হত্যাকান্ড। এই ঘটনার পরে ষষ্ঠীচরণ কংগ্রেসের কাছে আবেদন রাখেন, যে কোনো মূল্যে এই পবিত্রভূমি রক্ষা করতে হবে। কংগ্রেসের পরবর্তী সম্মেলনে এই জমিটি অধিগ্রহনের যৌথ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তার দায়িত্ব এসে পড়ে ষষ্ঠীচরণ মুখার্জির ওপরেই। দরজায় দরজায় গিয়ে অর্থসংগ্রহ করে প্রায় নয় লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেন।
১৯২০ সালের ১ আগস্ট পাঁচ লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজায় টাকায় কেনা হয় ৬.২৭ একর আয়তনের জমিটি। এই অপরাধে তিনি কারারুদ্ধ হন এবং ছাড়া পেয়ে আবার একই কাজে মন দেন। ১৯৫১ সালের ১ মে গঠিত হয় ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ ন্যাশনাল মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। এই মেমোরিয়ালের নকশা করেন আমেরিকান স্থপতি বেঞ্জামিন পোলক। ১৯৬২ সালে ষষ্ঠীচরণ মুখার্জী প্রয়াত হলে ট্রাস্টের দায়িত্ব এসে পরে পরবর্তী প্রজন্মের কাঁধে। পুত্র উপেন্দ্রনারায়ণ পারিবারিক ইলেকট্রিক সামগ্রীর ব্যবসায় রাশ টেনে ট্রাস্টের কাজে মনোনিবেশ করেন। উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁর পুত্র সুকুমার মুখোপাধ্যায়ও চাকরি ছেড়ে ট্রাস্টেই যোগ দেন। ২০১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের শতবর্ষ পূর্তিতে ভারত সরকার এই মেমোরিয়াল পুনর্নির্মাণের কথা জানায়। এই মেমোরিয়ালে নানা পরিবর্তন এলেও এর আগে কখনই হাত পড়েনি জালিয়ানওয়ালাবাগে ঢোকার মুখে সরু রাস্তাটিতে। মুঘলযুগের নানকশাহি ইট দিয়ে তৈরী ছিল এই রাস্তার দুধারের দেওয়াল। ২০২১-এর জুলাইয়ে ম্যুরাল দিয়ে অলঙ্কৃত করা হয়েছে ওই দেওয়াল। যাতে অতীতের নানা চিহ্নই গায়েব। নতুন করতে গিয়ে রক্তাক্ত হত্যার ইতিহাসকে মুছে ফেলাটাও কি একরকমের হত্যা নয়?
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – https://historica.fandom.com/
Discussion about this post