সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত জগমোহন পণ্ডিতের ‘দেশাবলী’ বিবৃতিতে জানা যায় – এই সময়ে সোনামুখীর গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি যথেষ্ট ছিল। একথা মেনে নিলে সোনামুখীতে ঘর বংশের শুরু সম্ভবত ১৬০০ শতাব্দীর কোন এক সময়ে। শ্রুতি পরম্পরায় জানা যায় বংশের প্রথম পুরুষ সুদূর বর্ধমান ও নদীয়া জেলার মধ্যবর্তী সীমানার ‘মাইপুর’ গ্রাম থেকে ভাগ্যান্বেষণে ব্যবসার জন্য সোনামুখীতে বসবাস শুরু করেন। সুদূর বিহারের ভজুড়িতে (অধুনা ঝাড়খণ্ডে) অবস্থিত সমগোত্রীয় ‘ঘর’ পদবীবিশিষ্ট গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের বংশধরদের কথা মেনে নিলে বলে যায় ‘ঘর’ গন্ধবণিক সম্প্রদায়ের অবস্থান ছিল ইছামতী নদীর তীরে কোন এক গ্রামে।
বিতর্কের খাতিরে একথা মানতে হয় ‘ঘর’ বংশের অস্তিত্ব সোনামুখী থেকে দূরে-বহুদুরে। প্রথম পুরুষ সোনামুখীতে এসে ব্যবসা শুরু করেন। সোনামুখী তখন বিষ্ণুপুর মৌজার অন্তর্গত। সম্ভবত ১৮১৩ সালে বংশের সুযোগ্য বুদ্ধিমান সন্তান পর্যায়ক্রমে বিশিষ্ট জমিদারে পরিণত হয়। রাজস্ব সংগ্রহের ফলে জমিদার ধন ও ঐশ্বর্যে পূর্ণ হয়। অর্থের প্রাচুর্য্য ধর্মের প্রতি আবেগ বাড়িয়ে দেয়। তাই বাংলা ১২৫৬ সালে কুলদেবতা লক্ষীনারায়ণ ঠাকুর ও শিবঠাকুরের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। সাথে সাথে দোল উৎসবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে দোলমন্দির। মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির কাজ আজও দর্শনীয়। দীর্ঘদিন ধরে চুন রং মন্দিরের সৌন্দর্য, ঐতিহ্য নষ্ট করেছে এবং বিকৃত করেছে।
সারা বছর কুলদেবতা শ্রীশ্রী লক্ষ্মীনারায়ণ জিউর পুজো, নিত্যসেবা, জন্মাষ্টমী, নন্দোৎসব ইত্যাদি পালনের পরেও দোল উৎসবটি বিশেষ প্রাধান্য পেয়েছে। তিনদিন উৎসবের দোল পূর্ণিমার দিন হোম, যজ্ঞ, পুজোর পর উৎসব শেষ হয়। এই তিনদিন দোল উৎসবের রেশ বজায় রেখে সন্ধ্যার পর সুসজ্জিত রূপার সিংহাসনে কুলদেবতা শ্রীশ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর জিউকে খোল কীর্তন, বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় দোলমন্দিরে। “আজ হোলি খেলব শ্যাম তোমার সনে/ একলা পেয়েছি তোমায় নিধুবনে।” গান গাইতে গাইতে শোভাযাত্রা করে মূল মন্দির থেকে দোলমন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়। মন্দিরে ঘূর্ণায়মান কাঠের চৌকিতে স্থাপন করে নাচ, গান সহযোগে আরতি হয়। এই তিনদিন রাতেই গ্রাম বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতি ‘যাত্রা গান’ আজও হয়ে আসছে। তবে জমিদারী বিলোপের সাথে সাথে আর্থিক সঙ্কটে উৎসবের জৌলুস ক্রমশ ফিকে হয়েছে।
Discussion about this post