জীবনে সৌভাগ্য আনার জন্য কতই না কাঠখড় পোড়াতে হয় বলুন! কিন্তু এই সৌভাগ্য বয়ে আনার জন্য কখনো কোনো উৎসবের কথা শুনেছেন? একটু অদ্ভুত শুনতে লাগছে তো? সৌভাগ্যের জন্য প্রার্থনা করা যায় কিন্তু উৎসবও হয়! আজ্ঞে হ্যাঁ, এরকম এক উৎসবের কথাই আজকে জেনে নেওয়া যাক। ইউরোপের বেশ জনবসতিপূর্ণ একটি দেশ হল বেলজিয়াম। বেশ কিছু ফরাসিভাষীদের বাস বেলজিয়ামের ওয়ালোনিয়া অঞ্চলে। মূলত তাদের দ্বারা প্রচলিত শহরের জমকালো এক উৎসবের নিদর্শন হল কার্নিভাল দ্যু বাশ্চ। উৎসবটির মূল আকর্ষণ হল অংশগ্রহণকারীরা তাদের আপনজনকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে কমলালেবু ছুঁড়ে মারেন। তারা বিশ্বাস করেন এর মাধ্যমে তাদের এবং আপনজনদের জীবনে সৌভাগ্য ফিরে আসবে। ঠিক একই সময় চলে খ্রিস্টানদের অ্যাশ ওয়েন্সডে উৎসবও।
ফেব্রয়ারীর শেষ দিকে শুভ সূচনা হয় এই সৌভাগ্য বয়ে আনার উৎসবটির। মোট তিনদিন ব্যাপী এই উৎসবের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় সপ্তাহের শুরুতে অর্থাৎ রবিবারে, তাই দিনটির নামকরণও করা হয়েছে ‘শ্রভ সানডে’। এরপরের দু’দিন যথাক্রমে ‘শ্রভ মনডে’ ও ‘শ্রভ টিউসডে’ নামে পরিচিত। উৎসবপ্রেমী সকলে এই ঐতিহ্যশালী জাঁকজমকপূর্ণ উৎসবে মেতে ওঠেন। সেদিন ড্রাম ও ভায়োলার মত নানা বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজে চারিদিকে একেবারে উৎসবের খাঁটি মেজাজ। প্রথমদিন শহরের রাস্তায় নানারকম থিমের আদলে এবং একরকম পোশাকে সেজে ওঠে নারী ও পুরুষ সদস্যরা। শুধু কি তাই! একরকম পোষাক পরিহিত পুরুষদের আবার আলাদা নামও রয়েছে – গিলে এবং মহিলারা পরিচিত প্যাসেন নামে। শুরুর দিন থেকেই তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার অভাব থাকে না। উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি অর্থাৎ ‘শ্রভ মনডে’ হল শিশু-কিশোরদের দিন। রঙিন কাগজ দিয়ে একইরকম পোশাকে তাদের এমন সুন্দর করে সাজানো হয় যে দেখে চোখ ফেরানো মুশকিল। স্থানীয় চার্চগুলোও এইদিন শিশুদের সাবলীলতায় এবং পিয়ানোর সুরে নতুন ছন্দে মেতে ওঠে। এ যেন অন্য এক পৃথিবীর নিদর্শন!
এবার পালা উৎসবের সবচেয়ে শেষ গুরুত্বপূর্ণ দিনটি অর্থাৎ ‘শ্রভ টিউসডে’। এই দিন ভোরের আলো ফোটার আগেই গিলে এবং প্যাসেনরা ড্রামের তালে তালে পা মিলিয়ে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এসে হাজির হয়। এখানেই শেষ নয়, উৎসবের নিয়ম অনুযায়ী ঠিক সকাল ৭ টার সময় তারা সকলে ওস্টার নামে শামুকের একরকম পদ এবং শ্যাম্পেন দিয়ে প্রাতরাশ করেন। বেলা বাড়লেই তারা টাউন হলের সামনে জড়ো হলে মেয়র তাদের মধ্যে থেকে কয়েকজনকে গলায় মেডেল পরিয়ে দেন। শহরের রাজপথে নির্বাচিত ১০০০ জন গিলেদের মিছিল বের হয় এবং সাথে থাকে আরেক নতুন চমক। প্রতিটি গিলের মাথায় থাকে উট পাখির পালকে তৈরি তিন কেজি ওজনের বিশাল টুপি। এই টুপির দামই নুন্যতম এক হাজার ইউরো। তাই মিছিলে অংশগ্রহণকারী পুরুষদের বেশ ভালোই খরচা হলেও তাদের কাছে শেষদিনের এই মিছিলে অংশ নেওয়াটাই রীতিমতো সম্মানের ব্যাপার।
মিছিল শেষে প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শুরু হয় কমলালেবু ছোঁড়ার উৎসব। সকলেই তাদের আপনজনদের দিকে লেবু ছুঁড়ে উৎসবের সমাপ্তি রচনা করে। তবে কাওকে আঘাত করে নয়, সারা রাস্তা ভিজে ওঠে লেবুর রসে। প্রশ্ন জাগতে পারে কমলালেবুই বা কেন? আসলে ওয়ালোনিয়া অঞ্চলে কমলালেবুকে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে মনে করা হয়। তাই বছর শুরুতে এই আয়োজন। ২০০৩ সালে ইউনেস্কো বেলজিয়ামের এই কার্নিভালকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘মাস্টারপিস অব দ্য ওরাল অ্যান্ড ইনট্যানজিবল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
Discussion about this post