সর্বধর্ম ও ভিন্ন সংস্কৃতির মিলনমেলা আমাদের বাংলা। সতেরো শতকের শেষ দিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে খ্রিস্ট ধর্মের আগমন ঘটে বঙ্গদেশে। সেই সময় বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠে বহু চার্চ ও মিশনারী। সম্প্রীতি প্রতীক হিসেবে আজও প্রাচীন এই স্থাপত্যগুলির বাংলার গৌরবময় ইতিহাসের বাহক। প্রাচীন এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে ২০০ বছরের প্রাচীন কালনার গির্জা। এটি বর্ধমানের দ্বিতীয় প্রাচীনতম গির্জা। বড়দিন থেকে শুরু করে ইংরেজি নববর্ষ বহু উৎসবপ্রিয় বাঙালি ভিড় জমান প্রাচীন এই গির্জায়।
কালনা বর্ধমান জেলার অন্তর্গত প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। প্রাচীন সময়ে কালনা ছিল নৌপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। ইংরেজরা প্রথম জলপথেই কালনায় আসে। কালনায় খ্রিস্টধর্মের প্রচার শুরু হয়েছিল ‘শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের’ উদ্যোগে। সেই সময় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের সহায়তায় খ্রিস্ট ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য কালনায় গঠিত হয়েছিল ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি’। আঠারো শতকের প্রথম দিকে ‘ইউনাইটেড ফ্রি চার্চ অব স্কটল্যান্ড’-এর উদ্যোগে মিশনপাড়ায় প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রাচীন এই গির্জাটির। বহু প্রাচীন নথিপত্র থেকে জানা যায়, এই গির্জায় একসময় বহু বিশিষ্ট ব্যাক্তিদের ধর্মান্তরণও ঘটেছিল। তবে ধর্ম প্রচার বা ধর্মান্তরণ করার পাশাপাশি শিক্ষা বিস্তার, হাসপাতাল তৈরির মতো সমাজসেবামূলক কাজেও যথেষ্ট অবদান লক্ষ্য করা যায় প্রাচীন এই প্রতিষ্ঠানের। মিশনারীদের উদ্যোগে ‘চার্চ অব স্কটল্যান্ড’ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় গির্জার পাশে তৈরি করা হয়েছিল একটি হাসপাতাল। শোনা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এই হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর জন্য এক যক্ষ্মা রোগীকে একবার কোলে করে নিয়ে এসেছিলেন। বর্তমানে এটি ‘পুরনো হাসপাতাল’ নামে পরিচিত।
স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রাচীন সময়ে শিক্ষার প্রসারের দিকেও যথেষ্ট নজর দিয়েছিলেন এই চার্চের মিশনারীরা। কালনার গির্জা কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে কালনার চার্চ লাগোয়া এলাকায় চারটি বালক এবং তিনটি বালিকা বিদ্যালয় তৈরি করা হয়েছিল। বিদ্যালয়গুলি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন রেভারেন্ড কুরি ও রেভারেন্ড তিয়ার। তৎকালীন সময়ে সমাজের নিয়মের বেড়াজালে অবহেলিত ও সমাজের পিছিয়ে পড়া আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে এই হাসপাতাল ও স্কুলগুলি ছিল আশার আলো।
তবে সময়ের বোঝায় আজ ভগ্নপ্রায় অবস্থা প্রাচীন এই গির্জাটির। জানা যায়, মাদার টেরিজা ১৯৯৪ সালে কালনার তৎকালীন বিডিওকে কালনার এই গির্জাটির সংরক্ষণের জন্য একটি চিঠি দিয়েছিলেন। তবে আজও এই গির্জায় রয়ে গিয়েছে পুরনো কাঠের চেয়ার, টেবিল এবং প্রার্থনা করার ডেস্ক। গির্জার ভিতরে প্রার্থনার সভাস্থলে একটি ফলক রয়েছে। তাতে লেখা, ‘রেভারেন্ড বিকে সরকারের স্মরণার্থক ফলক— ইনি পাঁচ বৎসর এই মণ্ডলীর পৌরোহিত্য করিয়া ১৯২৮ সালে ১৫ জুন প্রভুতে নিদ্রিত হন’।
Discussion about this post