নিজের দেশ, বিশ্বের প্রতিটি মানুষের কাছে আবেগ ও ভালবাসার জায়গা। মাতৃভূমির সম্মান রক্ষার জন্য লড়াইয়ের কাহিনী প্রতিটি দেশের নাগরিকদের কাছে গর্বের। তেমনি পাক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রাম বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য লড়াইয়ের সামনে রাজধানী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করেছিল সুবিশাল পাক বাহিনী। যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবীর সবথেকে বড়ো সামরিক আত্মসমর্পণ। দিনটি ছিল, ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ। এই দিনটিতেই পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। দিনটি বাংলাদেশে মহান বিজয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। এদিনই ঢাকার রমনা রেসকোর্সে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি।
পাকিস্তানের জন্মের সময় থেকেই পূর্ব অংশ, পশ্চিম অংশের থেকে বঞ্চিত হতে থাকে। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তান ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভয়াবহ আর্থিক শোষণের শিকার। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে এই শোষণের বিরুদ্ধে প্রথম লড়াই শুরু হয়। ১৯৭০ সালের ভোটে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন পরিষদে আওয়ামি লিগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের একক জনপ্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হন। তবে এই দলের নেতা জুলফিকর আলি ভুট্টো শেখ মুজিবুরকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না।
মুজিবরকে নিয়ে বৈঠক চলে, কিন্তু তা ফলপ্রসূ হয়নি। যার ফলে মুজিবর সারা দেশে ধর্মঘটের আহ্বান জানালে সমস্ত পূর্ববঙ্গে শুরু হয় আন্দোলন। ২৫ মার্চ রাতে মুজিব ও তাঁর ৫ সহযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার। আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে পাকিস্তানি সেনারা শুরু করে অপরেশন সার্চলাইট নামক ভয়াবহ হত্যালীলা। সেই সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেন। ভারত সবদিক থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। যার ফলে ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে দেখে, ৩ ডিসেম্বর ভারতের ওপর বিমান হামলা চালায় পাকিস্তান। উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার। ভারত সরাসরিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী যুক্ত হয়ে তৈরি হল যৌথ বাহিনী।
এই সম্মিলিত বাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তান। শেষ পর্যন্ত ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রায় ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা এভাবে আত্মসমর্পণ করে। সেই সময় রাষ্ট্রসংঘের সদস্য প্রায় সবক’টি দেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ঢাকায়, গোটা বাংলাদেশ জুড়ে সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্যকে আত্মসমর্পণ করাতে আরও বেশ কিছুদিন সময় লেগে যায়। রাস্তাঘাট মুখরিত হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।
Discussion about this post