শীতের আমেজ কাটলেই ধরা দেয় বসন্ত। তবে এই শীত আর বসন্তের মাঝে সেতু হয়ে থাকা ঋতুটি থেকে যায় অধরা। কথা হচ্ছে হেমন্তের। আর এই ঋতুর সংক্রান্তিকে ছুঁয়ে যায় এক অনন্য উৎসব। নবান্ন। ভাতের ভাপ ওঠার উৎসব। এ উৎসব চাষির ঘরে খিদে মেটার উৎসব।
নবান্ন নিয়ে জানতে গেলে বেশ কিছুটা সময়ে পিছিয়ে যেতে হবে। জানা যায়, একসময় বাঙালিরা নতুন ধান গুঁড়ো করে উৎসব করত জাঁকজমকভাবে। বছরের এই সময়ে গোলা ভরে উঠতো ধান। নবান্ন মূলতঃ গোটা অঘ্রাণ মাস জুড়েই পালিত হয় বর্তমানে। তবে এর প্রাথমিক সূত্রপাত হয় কার্তিক সংক্রান্তির দিন ভোরে। কারণ মধ্যযুগের বাংলাতে কার্তিক ছিল বছরের শেষ মাস। এই সংক্রান্তি তিথিতে গৃহস্থের বাড়ির একজনকে স্নান করে শুদ্ধবস্ত্রে যেতে হয় জমিতে। সেই জমিতে, যেখানে নবান্নের জন্য ধান লাগানো হয়। দূর্বা ঘাস, গঙ্গা জল, মণ্ডা বা সন্দেশ সহযোগে সেই ধান গাছকে পুজো করা হয়। পরে ধান পাকলে বাড়ির মহিলারা উপোস করে ধোয়া কাপড় পরে সেই ধান থেকে চাল সংগ্রহ করে। পরে সেই চাল গুঁড়ো করে তৈরি হয় নবান্নের সিন্নি।
বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ভোরাই গান ‘রাই জাগো রাই’ শোনা যায়। রাত তিনটে থেকে শুরু হয়ে যায় নবান্নের সূচনা। নবান্ন প্রসঙ্গে রাঢ়দেশীয় বৈষ্ণব কবি গোবিন্দদাস লিখেছিলেন – “আঘাণ মাস রাস রস সায়র/ নায়র মাথুরা গেল।/পুর রঙ্গিনীগণ পুরল মনোরথ/বৃন্দাবন বন ভেল।।” মাঠ জোড়া ধানের সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হওয়া আরও একটি গানের লাইন, “এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায়, বাতাস কাহার দেশে।” এভাবে আরও বিভিন্ন লেখায়, সাহিত্যে উঠে আসে এই উৎসবের কথা।
প্রথমে নবান্নের ভোগ দেওয়া হয় বাড়ির বাস্তু দেবতার উদ্দেশ্যে মাঝ উঠোনে, তারপর বাড়ির ছোটদের। এ ভোগে থাকে নতুন চালের ভাত, ডাল, ভাজা ইত্যাদি। কারোর বাড়িতে আলাদা করে হাঁড়ি চড়ে না উৎসবের এদিনে। পেটে ভাত জুটে বেঁচে থাকার গল্প বলে এই উৎসব। গ্রাম বাংলায় নবান্ন উৎসবের রেশ এখনও আছে, কিন্তু প্রাবল্য হয়তো ততটা নেই। আধুনিকতা চাপে তার অনেকটাই আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।
নবান্নের পরের দিনকে বলে পান্ত বা বাস নবান্ন। সেদিন নবান্নের দিনে তৈরি সমস্ত পদগুলির বাসি খাওয়ার নিয়ম। অনেক জায়গায় অবশ্য এই বাসি পদের সাথে যুক্ত হয় খাসির মাংস। সেদিনও উনুন জ্বলে না কারোর বাড়িতে। সারা বছর খাটনির এক অন্যরকম পারিশ্রমিক হিসেবে ধরা দেয় এই উৎসব। হারিয়ে যাওয়ার কালে এভাবেই গ্রাম গঞ্জে নিজস্ব দাপটেই বেঁচে থাকুক নবান্ন।
Discussion about this post