সময়টা ১৮৫৬ সাল। ভারতে তখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। ব্রিটিশ সরকারের চক্রান্তেই রাজত্ব খুইয়ে চিরতরে কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলেন তৎকালীন এক নামজাদা নবাব। নবাবী চলে গেলেও তাঁর চোখে জল নেই। কারণ তিনি মনে করতেন একমাত্র সঙ্গীত এবং কবিতাই প্রকৃত পুরুষের চোখে জল আনতে পারে। হ্যাঁ গল্পটা অওয়ধের শেষ নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর। সে সময় সিপাহি বিদ্রোহ চলাকালীন ইংরেজদের নজরবন্দি হয়ে ছিলেন ফোর্ট উইলিয়ামে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের ভঙ্গিতে নবাবের সংস্কৃতি মনষ্কতার কথা বিশেষ উল্লেখ করা হয়নি কখনোই। শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃত মনস্ক এই নবাব একাধিক বাদ্যযন্ত্রের সাথেও সখ্যতা করেছিলেন। ধর্মীয় বেড়াজাল যে কখনোই শিল্প ও সাহিত্যচর্চার গতি রোধ করতে পারে না, তাই শিখিয়েছিলেন নবাব স্বয়ং।
১৮৪৩ সালে ভাই সিকান্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসায় মঞ্চস্থ করেন নিজের লেখা গীতিনাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিসসা’। রাধা-কৃষ্ণের আখ্যানকে তিনি রূপ দিয়েছিলেন নাটকে। নাটকটি রচিত হয় উর্দুতে। ‘রহস’ নামে এক বিশেষ আঙ্গিকে রচিত এই নৃত্যনাট্য সে সময় শিল্পবোদ্ধাদের প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পণ্ডিতরা এটিকেই প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক বলে চিহ্নিত করে থাকেন। কলকাতায় নজরবন্দী থাকাকালীন তাঁর জলসায় সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর, যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তীর মতো বহু জ্ঞানীগুণী মানুষের সমাগম ঘটত। নবাব গজল ও ধ্রুপদ সঙ্গীতের কদর করতেন যথেষ্ট। শোনা যায় বিরিয়ানিও নাকি কলকাতায় এসেছিল নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের হাত ধরেই।
কবি, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার হিসেবেও নবাবের খ্যাতি কিছু কম নয়। কত্থক নিয়ে লিখেছিলেন সচিত্র বই ‘মুসাম্মি কি বানি’। এছাড়াও কুস্তি, ঘুড়ি ওড়ানো, মুরগী লড়াই, পায়রা পোষা – এইসবে নবাবের আসক্তি ছিল। ১৮৮৭ সালে নবাব যখন মারা যান, সমাজের নানা স্রোতের দশ হাজার শোকাহত মানুষ ভিড় করেন তাঁর শেষ যাত্রায়। ব্রিটিশ সরকার তাঁর স্মৃতি মুছে ফেলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল কিন্তু এই শহর যেন তাকে আগলে রেখেছে।
Discussion about this post