বাড়ীর পিছন দিকের লুকোনো এক চিলেকোঠায় লুকিয়ে ছিল ছোট্ট মেয়েটি। কত দিন? নাহ, বেশি নয় মোটেই। মাত্র ৭৬১ দিন, মানে দুই বছরের একটু বেশি। কী! চোখ কপালে উঠে গেল? আরও অবাক হবেন যখন শুনবেন সেই চিলেকোঠার আয়তন ছিল মাত্র ৪৫০ বর্গফুট। আর ঠিক ওইটুকু জায়গাতে মেয়েটি শুধু একা নয়, তার সঙ্গে লুকিয়ে ছিল আরও সাত জন। কেন? কারণ বাইরে তখন ঘোরাঘুরি করছে নাৎসী গেস্টাপোর দল। আকাশ থেকে অনবরত বোমা বর্ষণও শুরু হয়েছে। সুতরাং বাইরে পা রাখলেই সব শেষ। বাঁচার একমাত্র উপায় ছিল ঘরে বন্দী থাকা।
মেয়েটির জন্ম ১৯২৯ সালের ১২ই জুন। জাতিতে সে ছিল ইহুদি। ১৯৩৩ সালে তার পরিবার আমস্টারডামে আসে। ১৯৪২ সালে নাৎসীরা আমস্টারডাম দখলের পর শুরু হয় যথেচ্ছ পরিমাণে ইহুদি হত্যা। ছোট্ট মেয়েটির বাবার এক লুকোনো চিলেকোঠা ছিল। শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে সেখানেই লুকিয়ে থাকতে শুরু করল মেয়েটি। দুই বছর ধরে ওইটুকু ছোট্ট জায়গাতেই আটকে থাকা। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে বাথরুম সারা, খাওয়া-দাওয়া থেকে ওইখানেই দুপুর গড়িয়ে রাতের দেখা পাওয়া। বাইরে তখন সারা শহর জুড়ে শুধুই বিভৎসতা।
এখন আমাদের সব্বার হাতে হাতে সেলফোন আর ইন্টারনেট। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া বা ভিডিও কলে আড্ডা জমানো, ল্যাপটপ আর নেটফ্লিক্স! উন্নত প্রযুক্তির ঠিক কী কী নেই আমাদের সঙ্গে আজ? তা সত্ত্বেও এই কয়েকটা দিন ঘরে বন্দী থেকেই আমরা হাঁপিয়ে উঠেছি। অথচ ভাবুন! ১৯৪২ সালে সেসব প্রযুক্তির কথা কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। তাহলে দু-দুটো বছর সেই ঘরবন্দী দশায় কীভাবে সময় কেটেছিল সেই ছোট্ট মেয়েটির? উত্তর- ডায়েরি লিখে। আজকাল সামান্য অবসরেরও ডায়েরি লেখার কথা কেউ ভুলেও ভাবি না। কিন্তু সেই বন্দীদশায় মাত্র বছর পনেরোর মেয়েটির একমাত্র সঙ্গী ছিল ডায়েরিই। যেখানে প্রতিদিন সে লিখেছে তার কথা, তার বাবা-মার কথা, বাইরের উত্তপ্ত পরিস্থিতির কথা। রয়েছে চারপাশের অস্থির অবস্থার নিঁখুত বর্ণনাও। সেসবই অকপটে লিখে গেছে সে। কী সব সাংঘাতিক কথা সেগুলো! “মানুষের নাকি ধৈর্য্য নেই, কাগজের আছে।” মানুষ আরেকজন মানুষের আদর্শ বা বিশ্বাস এসবের কোনও সম্মান দেয় না, কাগজ কিন্তু দেয়। মেয়েটি তাই কাগজকেই বলেছিল তার সমস্ত কথা!
বছর দুই পর, ১৯৪৪ সালের আগস্ট মাসের এক সকালে মেয়েটি ও তার পরিবার নাৎসী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। তার ডায়েরিটিও শেষ বারের মত লেখা হয় সেদিন। বখশিশের বিনিময়ে কে তাদের লুকানো বাসস্থানের কথা জার্মানদের কাছে জানিয়ে দিয়েছিল, তা অবশ্য জানা যায়নি। ধরা পড়ার পর তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানেই ১৯৪৫ সালে টাইফাসে আক্রান্ত হয়ে মেয়েটি আর তার বোন মারা গিয়েছিল। যুদ্ধ শেষে তার পরিবারের একমাত্র বেঁচে থাকা ব্যক্তি, মেয়েটির বাবা আমস্টারডামে ফিরে আসেন। খুঁজে বের করেন মেয়েটির ডায়েরি। তার প্রচেষ্টাতেই ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত হয় সেটি। ওলন্দাজ ভাষা থেকে পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালে প্রথম বারের মতো ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয় ডায়েরিটি। নাম হয় ‘দ্য ডায়েরি অফ আ ইয়াং গার্ল।’ এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝে গেছেন কার কথা বলা হচ্ছে? হ্যাঁ, বছর পনেরোর সেই বাচ্চা মেয়েটির নাম অ্যানা ফ্রাঙ্ক। যার জীবন দর্শন এখনও ভাবিয়ে তোলে আমাদের। জীবনের সবথেকে কঠিন পরিস্থিতিতেও মেয়েটি আনন্দ, সৌন্দর্য, মানুষের মহত্ত্ব এসবের উপর বিশ্বাস হারায়নি। ভেবেছে সুদিন ঠিক আসবেই! আর আজ আমরা এইটুকুতেই এত ভেঙে পড়ছি! ওইটুকু এক বাচ্চা মেয়ে ঘরবন্দী থেকেও পৃথিবীকে নতুন রূপে চিনতে পারলে আমরা কী পারব না? আসুন না একটু চেষ্টা করেই না হয় দেখা যাক। সফল আমরাও হব!
Discussion about this post