বাংলা ক্যালেন্ডারের বৈশাখ মাসের প্রথম দিন থেকে নতুন বছর বা নববর্ষের সূচনা হয়। এক নতুন বছরের শুরুর দিন হিসাবে এদিন ব্যবসায়ীরা উদযাপন করেন হালখাতা উৎসব। তবে এই হালখাতার উৎসব কিন্তু খুব নতুন কিছু নয়। প্রাচীন কালের প্রথা মেনেই এই রীতি চলে আসছে বহুকাল ধরেই। বাংলায় হালখাতা প্রসঙ্গে সবার আগেই উঠে আসবে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কথা। প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রজাদের বকেয়া কর-খাজনার খাতা লাটে তুলে দিয়ে বৈশাখের প্রথম দিন তিনি চালু করতেন নতুন একটি খাতা। এই উপলক্ষ্যেই হালখাতার দিন কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে বসত জাঁকজমক পূর্ণ উৎসব।
সেদিন রাজবাড়ির দরজা সকলের জন্যই খুলে যেত। দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ খাজনার হিসাব দিতে আসতেন। আগত প্রজাদের হাতে তুলে দেওয়া হত বকেয়া খাজনার হিসাব। বছরের মধ্যে একমাত্র এই একটি দিনেই প্রজারা সরাসরি রাজার হাতে কর নিবেদন করার সুযোগ পেতেন। এদিকে রাজদর্শনের মত ‘পুণ্য’ কাজে তো আর খালি হাতে আসা যায় না! তাই প্রজারা নিজেদের সঙ্গে নিয়ে আসতেন কিছু নজরানাও। সেইসঙ্গে আরও একটি দুর্লভ সুযোগ পেতেন তারা। তা হল, রাজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের সুখ দুঃখের ঝাঁপি উজাড় করে কথা কওয়া। খাজনা পর্ব মিটে গেলে বারোদুয়ারির প্রাঙ্গণেই পংক্তিভোজনে বসতেন প্রজারা। তদারকি করতেন রাজা স্বয়ং!
সেদিন গৃহদেবতা বড় নারায়ণকে ঘিরে হত পুণ্যাহ, কপিলা গীতি। এছাড়া বসত কাব্য সম্মেলন ও উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসরও। গীতিকারদের দেওয়া হত পঞ্চশস্য। বিশিষ্ট কোনও পণ্ডিতকে নির্বাচন করে দান করা হত স্বর্ণ গাভীও। হালখাতার এই অনুষ্ঠানে বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি আমন্ত্রিত থাকতেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন লর্ড ক্লাইভ, বর্ধমানের রাজা কৃষ্ণরাম, শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণদেব প্রমুখ। তবে এদিন শুধু খাজনা আদায় বা সারা বছরের জন্য মঙ্গল কামনাই কৃষ্ণচন্দ্রের একমাত্র লক্ষ্য থাকত না। দেশের অন্যান্য রাজার কাছে নিজেকে আলাদা কিছু প্রমাণ করার তাগিদও থাকত এর নেপথ্যে।
কৃষ্ণনগরের ব্যবসায়ীদের দীর্ঘকালের সংস্কার ছিল রাজবাড়ির ঠাকুর দালানে ব্যবসার নতুন খাতা ছুঁইয়ে আনা। সেই প্রথা বহু বছর ধরেই চলে এসেছে। তবে এখন ব্যবসায়ীদের ইচ্ছা থাকলেও রাজবাড়ির পরিবেশ পরিস্থিতি পালটে যাওয়ার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠে না। জমিদার প্রথা তো কবেই উঠে গিয়েছে! খাজনা বা কর আদায়ের ব্যাপারও তাই নেই। রাজবাড়ির সেই জাঁক-জমক পূর্ণ অনুষ্ঠানও আজ আর নেই। তবে আজও হালখাতার দিন রাজবাড়ির গৃহদেবতার পায়ে নতুন খাতা পুজো করানো রীতি পালিত হয়ে আসছে।
Discussion about this post