‘প্রতিশ্রুতি’! শুনতে মধুর, তবে কি পালনেও? নৈব নৈব চ! সৎ সাহস আর ইচ্ছের অভাবে কত প্রতিশ্রুতি এখনো শব্দাকারেই নিবন্ধ! তবে এক গল্পে ‘প্রতিশ্রুতি’ থেকে মুখ ফেরাননি নায়ক। অসহায় শিশুগুলোকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি নায়ক পালন করেছেন অক্ষরে অক্ষরে। নাহ্, নায়কের কোনো অতিমানবিক শক্তি নেই। তবে তিনি ৪০ ফিট গভীর বন্যার জল সাঁতরে মানুষ বাঁচাতে পারেন। মার্ভেলের কোনো সুপারহিরোও নন, পেশায় রিকশা চালক। তবে অনাথ শিশুদের এক টুকরো ছাদ দেওয়ার লক্ষ্যে ছেড়ে আসতে পারেন নিজের ঘর। তাঁর গল্পে ইচ্ছে আর সামর্থ্যের লড়াইয়ে সামর্থ্যও মাথা নত করে। যেন এই গল্প তাঁর জন্যই লেখা। পূর্ব মেদিনীপুরের ভক্তিপদ মাইতি এই গল্পের নায়ক!
তখন ২০০৭ সাল। আয়লা বিধ্বস্ত এলাকায় তিনিও গিয়েছেন ত্রাণ বিতরণে। সময়টা বেলা গড়িয়ে বিকেল, তখন তাঁরা গোসাবায়। হঠাৎই ভক্তিবাবুর কানে আসে একটি বাচ্চার আর্তনাদ! ভয়ঙ্কর স্রোতে কোনোরকমে একটুকরো খড়ের গাদা আঁকড়ে ভেসে আছে। ভক্তিবাবু জলে ঝাঁপ দিয়ে দেন সাত-পাঁচ না ভেবে। শিশুটিকে উদ্ধার করে একটি ত্রাণ শিবিরে নিয়ে এলে, সেখানে আবিস্কার করেন আরো কতগুলি অসহায় মুখ। খিদের জ্বালায় প্রত্যেকে কাঁদছে। সকলকে নিয়ে স্থানীয় প্রধানের কাছে গেলে তারাও মুখ ফিরিয়ে নেয়। তবে ভক্তিবাবু হাল ছাড়েননি। একপ্রকার জেদেই তিনি বাচ্চাগুলোকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়িতে। কিন্তু যাঁর নিজেরই সংসার কোনোরকমে চলে, তাঁর ঘরে ২৬ জন শিশুর জায়গা কোথায়?
পরিবার থেকেও প্রবল আপত্তি। শেষ পর্যন্ত, বাচ্চাগুলোর জন্য একটি বাড়ি পেলেন বটে। তবে টাকা? পরিবার থেকে লুকিয়ে নিজের একখানি জমি বিক্রি করে অর্থের যোগান হল। আশ্রয় আপাত নিশ্চিত, এবার চলল খাদ্য-বস্ত্রের খোঁজ। কিন্তু একজন রিক্সাচালকের কতটুকুই বা আয়? একমুঠো চালের জন্য গ্রামে দ্বারে দ্বারে ঘুরলেন। সাহায্য পেলেন ঠিকই, তবে মুখ ফেরালেন বেশিরভাগই। সেই ইচ্ছেশক্তির উপরে ভর করেই আজ ৮৫ জন শিশুর আশ্রয় তাঁর আশ্রমে। ‘কৃষ্ণনগর অনাথ শিশু আশ্রম’। তবে এই ৮৫ জনের বাইরেও অনেক অসহায়-আর্তের ঠিকানা এই আশ্রম। বাচ্চা-বুড়ো কাউকেই ফিরিয়ে দেন না ভক্তিবাবু। সব মিলিয়ে শতাধিক মানুষের একমাত্র ভরসার স্থল। বাচ্চাদের খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান তো বটেই, নিশ্চিত করেছেন তাদের পড়াশোনাও। তাদের মধ্যেই একজন সুস্মিতা সিং, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট কলেজে সংস্কৃত অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। দিল্লীতে সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ে নাচের প্রতিযোগীতায় প্রথম হয়। ইচ্ছে আছে উকিল হওয়ার। তবে পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অর্থাভাব।
রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ থেকে অর্থ সাহায্য পেলেও ভক্তিবাবুর কপালে চিন্তার ভাঁজ। বর্তমানে তিনি টোটোচালক। তবে এই দুর্মূল্যের বাজারে এতগুলো ছেলেমেয়েকে নিয়ে চলাটা যে সত্যিই কঠিন! পাশে পাননি কোনো সরকারি সাহায্যও। এতগুলো ছেলেমেয়ের ভরসা একমাত্র ভক্তিবাবু! সুতরাং হার মানা যেন তাঁর অভিধানের বাইরে। প্রতিকূলতা পেরিয়েও তিনি প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। ওই সামান্য আয়েও হাল ছাড়েননি। তিনিও আশা রাখছেন, দুশ্চিন্তার মেঘ কাটিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াবেন কেউ। আমরাও না হয়, হাত বাড়ানোর প্রতিশ্রুতিটা রাখলাম ভক্তিবাবুর কাছে!
ভক্তিপদ মাইতির সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে ফোন নম্বর 9933313240
Discussion about this post