মানুষের বেঁচে থাকার জন্য যেমন খাদ্য ও জলের প্রয়োজন, তেমনই প্রয়োজন ঘুম। শরীর ও মস্তিষ্ককে পুনরুজ্জীবিত করতে প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টা ঘুম অপরিহার্য। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে, দীর্ঘ সময় ঘুমহীনতা প্রাণঘাতী হতে পারে। অথচ ইতিহাসে এক সৈনিকের জীবনে ঘটেছিল এর সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী অভিজ্ঞতা। হাঙ্গেরির পল কের্ন ছিলেন সেই মানুষ, যিনি প্রায় চার দশক ধরে ঘুম ছাড়াই বেঁচে ছিলেন। যা আজও চিকিৎসাবিজ্ঞানের কাছে এক রহস্য।
১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন গ্যালিসিয়ার ফ্রন্টে কের্ন শত্রুপক্ষের গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন। গুলি তার ডান দিকের কপাল ভেদ করে মস্তিষ্কের সামনের অংশ, অর্থাৎ ফ্রন্টাল লোব-এ লাগে। সাধারণত এ ধরনের আঘাত মৃত্যুঘাতী হয়, কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি বেঁচে যান। তবে বেঁচে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনে শুরু হয় এক অস্বাভাবিক পরিবর্তন, তিনি আর কখনো ঘুমাতে পারলেন না। চিকিৎসকেরা ভেবেছিলেন এই সমস্যা সাময়িক, কিন্তু দিন গড়িয়ে মাস, মাস থেকে বছর পেরিয়ে গেলেও ঘুম তার জীবনে আর ফেরেনি।
যুদ্ধ শেষে পল কের্ন ফিরে আসেন বুদাপেস্টে এবং একটি সরকারি পেনশন অফিসে কেরানির চাকরি নেন। বিস্ময়ের বিষয়, ঘুমহীনতা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একেবারেই স্বাভাবিক। প্রতিদিন নিয়মিত অফিস করতেন, বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন, বই পড়তেন এবং সামাজিক জীবন উপভোগ করতেন। কেবল রাতগুলোতে অন্যদের মতো শুয়ে ঘুমোনোর পরিবর্তে তিনি কাটাতেন হাঁটাহাঁটি করে, বই পড়ে বা খাবার খেয়ে। তার শারীরিক বা মানসিক অবস্থায় কোনো দুর্বলতা চোখে পড়েনি, যা চিকিৎসক ও বিজ্ঞানীদের আরও বেশি হতবাক করে।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ফ্রন্টাল লোবের আঘাতই তার মস্তিষ্কের ঘুম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়। কেউ কেউ আবার মনে করেন, হয়তো তিনি অজান্তেই ক্ষণিকের জন্য ‘মাইক্রো-স্লিপ’-এ চলে যেতেন, যদিও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঐতিহাসিক তথ্য বলছে, ১৯৪১ সালের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল কের্ন তখন টানা ২৩ বছর ঘুমাননি। অবশেষে প্রায় চার দশক ঘুমহীন জীবন কাটিয়ে তিনি ১৯৫৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পল কের্নের ঘটনা আজও এক অমীমাংসিত রহস্য হয়ে রয়েছে, যা প্রমাণ করে যে মানবদেহ ও মস্তিষ্কের ভেতরে এমন সব অজানা ক্ষমতা লুকিয়ে আছে, যা বিজ্ঞানের বর্তমান সীমাবদ্ধতার বাইরে।
Discussion about this post