যতই আমরা সারাবছর পাশ্চাত্য কায়দাকানুন নিয়ে মাথা ঘামাই না কেন, বাঙালিয়ানায় ভরপুর আমাদের রোজনামচায় আমরা কিন্তু সকলেই মনে প্রাণে বাঙালি। বাংলার বিভিন্ন উৎসব হোক কিংবা মেলা, এর সাথে মিশে থাকে বাঙালির আবেগ, বহু প্রাচীন রীতি ও নানান ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য মেনে বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ সামিল হন নানান উৎসবে। তেমনই এক উৎসব হল উত্তর ২৪ পরগনা জেলার গোবরডাঙা অঞ্চলের বহু পুরনো এক ঐতিহাসিক মশলা মেলা। চলুন জেনে নেওয়া যাক কী এই মেলার মাহাত্ম্য!
শুরুতেই যা না বললে নয় তা হল এই বছরে মেলাটি ২০১ বছরে পা দিল। কিন্তু আজও একই উদ্যমে মেলাটি আয়োজিত হয়ে চলেছে এই অঞ্চলের সুপ্রসিদ্ধ প্রসন্নময়ী কালীবাড়ির পাশের মাঠটিতে। মেলার ইতিহাস সম্পর্কে জানতে গেলে ফিরে যেতে হয় বাংলার ১২২৯ সাল(ইংরেজির ১৮২২) এর পয়লা বৈশাখের দিনটিতে। সেসময় এই অঞ্চলের জমিদার খেলারাম মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাবনা থেকে জমিদার বাড়ি লাগোয়া প্রসন্ন পার্কে যমুনার তীরে প্রথম শুরু করেছিলেন এই মেলাটি। ভাবনা ছিল এই যে বাংলা নববর্ষের প্রথম দিনে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল বিক্রির একটা জায়গা পাবে আর বিক্রি করে যা টাকা পাবে সেই দিয়ে সহজেই জমিদারের খাজনাও মিটিয়ে দিতে পারবে। মূলত এই কারণেই সেদিন বসেছিল মেলা। তখন মেলাটির নাম ছিল গোষ্ঠ বিহার মশলা মেলা।
তবে আজ আর নেই সেই জমিদারি প্রথা। পেরিয়েছে দুটো শতক। তবু ঐতিহ্য মেনে আজও মেলাটি চলে আসছে নানা প্রান্ত থেকে আগত কৃষকদের হাত ধরে। নববর্ষের দিন থেকে টানা ১০ দিন চলতে থাকে এই মশলা মেলা। মোটামুটি পয়লা বৈশাখের আগের রাত থেকেই মাঠে বিক্রেতারা তোড়জোড় করতে শুরু করে দেন। ভোর চারটে থেকে শুরু হয়ে যায় বেচাকেনা। এই মেলার মূল আকর্ষণীয় দিক হল গোটা মশলা, প্যাকেটের গুঁড়ো মশলার যুগে যা এখন বেশিরভাগ বাড়ির হেশেঁল থেকেই উধাও। বিভিন্ন জায়গা থেকে ক্রেতারাও তাই আসেন ঝাড়াই-বাছাই করে নিজেদের পছন্দমতো গোটা মশলা কেনার লোভে। তবে উল্টোদিকেই আবার রয়েছে গুঁড়ো করারও মেশিন। তাই মশলা থেকে শুরু করে গম–সবকিছুই ক্রেতারা ইচ্ছে করলে মেশিনে ভাঙিয়েও নিতে পারেন।
এই মেলায় ঢোকার মুখে প্রথমেই চোখে পড়বে দু’পাশে দুটি হালকা হলুদ রঙের থাম, যেটি আসলে সিংহদুয়ার। আজ সিংহও নেই, দুয়ারও ভেঙে গেছে। কেবল পড়ে আছে থামদুটি, যেটি আসলে ছিল গোবরডাঙার আদি জমিদারবাড়ির প্রবেশপথ। স্থানীয়দের কথায়, এই জমিদারবাড়ি “মেজোবাবুর বাড়ি” নামে পরিচিত। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মেলার বয়স শুনলে অবাক হতে হয় বইকি! সিপাহী বিদ্রোহ, দুই বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন প্রভৃতি অনেক সময় অনেক টালমাটাল অবস্থা হয়েছিল দেশে। কিন্তু এই মেলায় কোনও প্রভাব পড়েনি। আজও একই উদ্যমে নিজেদের পসরা সাজিয়ে ক্রেতাদের চাহিদা পূরণ করে চলেছেন মশলা হাটের ব্যবসায়ীরা।
চিত্র ঋণ – Pantho – Pother Golpo পান্থ-পথের গল্প
Discussion about this post