“সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে, বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।” এই মন্ত্র পাঠ দিয়েই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিটি শিক্ষার্থীর গৃহে মাঘ পঞ্চমী তিথিতে বাগদেবীর আরাধনা হয়ে থাকে। কিন্তু এই চেনা ছকের বাইরে পথ চলেছিলেন বাঁকুড়া জেলার সোনামুখীর জমিদার অধরচন্দ্র দে। সময়টা তখন ১৩১৩ বঙ্গাব্দ। ছয় পুত্র সন্তানের পিতা এরকমই এক মাঘ পঞ্চমী তিথিতে শুরু করেছিলেন এক সরস্বতী পুজোর। সেই বছর মকর সংক্রান্তির দিনে ছিল সূর্য গ্রহণ, আর সেই দিন জমিদার মশাই স্বপ্নাদেশ পান মন্দির প্রতিষ্ঠার। যে মন্দিরে দেবী সরস্বতীর সাথে একচালার মধ্যেই থাকবেন তাঁর ভাই বোনেরা লক্ষ্মী, কার্তিক ও গণেশ।
বৈষ্ণব জমিদার অধর চন্দ্র দে’র কণ্ঠে মূল্যবান অলংকারের বদলে সর্বদা স্থান পেত তুলসীর মালা, কপালে চন্দনের তিলক,মুখে হরিনাম আর অঙ্গে অতি সাধারণ নামাবলী। দে বংশের বর্তমান এক উত্তরসূরী সুমন্ত দে মহাশয়ের কথা থেকে জানা গেল বেশ কিছু তথ্য। অধরচন্দ্র দে প্রতিষ্ঠিত মূল মন্দিরটির গায়ে বিভিন্ন কারুকার্যের সাথে খোদিত ছিল অধর চন্দ্র বাবুর লেখা একটি শ্লোক। যা থেকে বোঝা যায় যে তিনি চেয়েছিলেন তাঁর ছয় সন্তানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও বিদ্যা-জ্ঞানের প্রতি তাদের আনুগত্য যেন সর্বদা অটুট থাকে। আর বংশ পরম্পরায় এই পুজো নিষ্ঠার সঙ্গে তারা যেন পালন করে। আজ এই পুজো ১১৭ বছর অতিক্রম করল। চারদিন ব্যাপী এই পুজোয় সামিল হন দেশ বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাঁচশোর অধিক দে পরিবারের সদস্যরা। তাদের কাছে সরস্বতী পুজো হলো এক বহু প্রতীক্ষিত পারিবারিক পুনর্মিলন উৎসব।
পুজোর দিন সকালে প্রথমে কুলদেবতা দামোদর জীউ ও গৃহলক্ষ্মীকে সরস্বতী মন্দিরে নিয়ে আসা হয়। তারপর শুরু হয় মূল পুজো, পুষ্পাঞ্জলি, হোম, আরতি ও প্রসাদ দেওয়া। সেদিন প্রসাদে নিবেদন করা হয় ফল, মিষ্টি আর শুকনো খাবার। সন্ধ্যায় হয় বিশেষ সন্ধ্যারতি। দ্বিতীয় দিন পুজোর পাশাপাশি সন্ধ্যায় আয়োজন করা হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। তৃতীয় দিনে মধ্যাহ্নে মহাভোগ নিবেদন করা হয়। আর শেষ দিনে পুজোর পর কুলদেবতা দামোদর ও গৃহলক্ষ্মীকে সরস্বতী মন্দির থেকে গর্ভগৃহে নিয়ে আসা হয়। মধ্যাহ্নভোজের পর যখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে পরিবারের মেয়ে বউরা দেবীবরণ করেন। তারপর সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা ও ঘট নিরঞ্জন করা হয়। আদি মন্দিরটির ভগ্নপ্রায় হয়ে পড়ায় তা নতুন আঙ্গিকে গড়ে তোলার ভার নিয়েছেন বর্তমান দে পরিবারের সদস্যরা। বর্তমান মন্দিরটিতেও যেন আদি মন্দিরের সমস্ত ছোঁয়া থাকে তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছেন আজকের উত্তরসূরীরা।
Discussion about this post