কলকাতা থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে, কাটোয়া অভিমুখে অবস্থিত ছোট্ট শহর কালনা। বর্তমান নাম ‘অম্বিকা কালনা’। অম্বিকা কালনা নামকরণ মা অম্বিকা অর্থাৎ দেবী দুর্গার থেকে হয়েছে। ষোলশ শতকে কালনার পবিত্র ভূমিতে আগমন ঘটে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর। সেই সময় কালনার অধিবাসীরা দীক্ষিত হতে শুরু করেন বৈষ্ণব ধর্মে। তখন থেকেই মন্দির তৈরী শুরু হয় কালনাতে। আঠেরো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে অধিকাংশ মন্দির তৈরী হয় কালনাতে। বর্তমানে কালনায় দেখতে পাওয়া সব মন্দির বর্ধমান রাজের তৈরী।
কালনার বুকে অবস্থিত বর্ধমান জেলার অন্যতম আকর্ষণ বহু প্রাচীন ১০৮ শিব মন্দির। প্রতিবছর শিবরাত্রি উপলক্ষে অপরূপ সাজে সেজে ওঠে এই মন্দির। বর্ধমান জেলা সহ পাশ্ববর্তী অঞ্চল থেকে বহু পুণ্যার্থী পুজো দিতে ভিড় জমান শিবরাত্রিতে। বহু ভক্ত ১০৮ টি মন্দিরে ঢুকে প্রতিটি শিবলিঙ্গে জল ঢেলে ব্রত পালন করে থাকেন। শিবরাত্রি তিথিতে ৭ দিনের মেলা বসে মন্দির ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায়।
স্থানীয় ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১০৮ শিব মন্দিরের কথা বলা হলেও সেখানে রয়েছে ১০৯ টি মন্দির। এক জায়গায় জপমালার আকারে বিন্যস্ত রয়েছে ১০৮ টি মন্দির। আর তার থেকে একটু দূরেই অবস্থিত বাকি একটি মন্দির। ঠিক অনেকটা গলার হারে লকেটের মতো। মোট ১০৯টি স্থাপত্যকে গেঁথে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এই মন্দির। প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে বর্ধমানের নবাবহাটের মহারানি বিষণকুমারী এই মন্দির গড়েছিলেন। জাঁকজমকের সাথে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই মন্দিরের। জানা যায়, মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার সময় প্রায় লক্ষাধিক সাধুর উপস্থিতি ঘটেছিল সেখানে।
এই শিবমন্দির প্রতিষ্ঠার সাথে জড়িয়ে আছে এক প্রাচীন রোমহর্ষক ইতিহাস। এই মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল ১৭৮৮ খ্রিস্টাব্দে। শেষ হয়েছিল ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে। ওই সময় বর্ধমান সংলগ্ন নবাবহাট এলাকায় এক মহামারি দেখা দিয়েছিল। তাতে মৃত্যু হয় সেখানের বহু সাধারণ মানুষের। ঠিক তখনই এই মন্দির গড়ে বাসিন্দাদের ঈশ্বরমুখী করে স্বজন হারানোর শোক ভোলানোর চেষ্টা করেন বর্ধমানের মহারানি বিষণ কুমারী । এই সদর্থক ভাবনা সামনে রেখে নবাবহাটে এই একশো আট শিব মন্দির গড়ে ওঠে।
মন্দিরটি ওড়িশার বালেশ্বরের মন্দিরের আটচালার নকশার আদলে নির্মিত। মন্দির গুলির অবস্থান পাশাপাশি হলেও প্রতিটি মন্দিরের সামনে রয়েছে খোলা টানা বারান্দা। প্রতিটি মন্দিরের একটি দরজা। সব মন্দিরে রয়েছে কষ্টিপাথরের গৌরীপট্ট-সহ শিবলিঙ্গ। প্রতিষ্ঠার সময়ে সবগুলি মন্দিরের সামনেই একটি করে বেল গাছ রোপন করা হয়েছিল বলে জানা যায়। তবে বর্তমানে সেগুলি আর নেই।
কালনার এই ১০৮ মন্দিরমালা বর্ধমানের এক অনন্য শিল্পকীর্তি। এই মন্দির নব কৈলাস মন্দির নামেও পরিচিত। এটি পূর্ব বর্ধমান তথা পশ্চিমবঙ্গের পুরনো একটি পুণ্যস্থান। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সারাবছর বহু ভক্তরা আসেন এখানে। এখানে এলে মনের সমস্ত ভার কেন দূর হয়ে যায়। তাই কালনার কাছাকাছি এলে একবার এই শিব মন্দির দেখতে আসতেই পারেন।
Discussion about this post